নারী সমাজের এই দেশে কাজ করার জন্য অনুমতি মিলত না, অনুমতি মিললেও কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন না। মূলধনের সংকট ছিল। তবে বর্তমানের চিত্র ভিন্ন। এখন নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, কাজ করার স্বাধীনতাও পাওয়া গেছে। কিন্তু কয়েকটা জায়গায় এখনো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে।
২০২০ সাল থেকে করোনার প্রকোপে অসংখ্য পরিবারের উপর নেমে এসেছে অর্থনৈতিক সংকট। সেই সংকট লাঘব হয়েছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে অনেকে। ঘর থেকে বের হয়ে নারীরা কাঁধে নিয়েছে পরিবারের হাল। আমরা পেয়েছি অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা। শুরু হয়েছিল টিকে থাকার লড়াই দিয়ে, সেই লড়াই এখনো চলছে। সবাই শুধু সফলতার গল্পটাই শুনে, এর পেছনের কষ্টটা কিন্তু কেউ দেখে না।
এমন অনেক নারী আছেন, যে কি না পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন সেই করোনাকালে, অথচ তাদের ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ছিল না কোনো উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। সেই জায়গা থেকে একজন নারীর ঘুরে দাঁড়ানো সহজ কোনো ব্যাপার ছিল না, কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।
তাদের ছিল না কোনো পুঁজি, ছিল না কোনো বিজনেস প্ল্যান কিন্তু গত প্রায় দুই বছর তারা নিজেদের উদ্যোগ ধরে রেখেছেন, উদ্যোগের পাশাপাশি নিজের সংসার চালাচ্ছেন।
এমন অনেক নারী আছেন, যে কি না পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন সেই করোনাকালে, অথচ তাদের ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ছিল না কোনো উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন…
করোনার সময় থেকে নতুন পুরাতন মিলিয়ে প্রায় ৪ লক্ষাধিক নারী উদ্যোক্তা কাজ করে যাচ্ছে আমাদের উই ফোরামে। কিন্তু এদের বেশিরভাগই পায়নি সরকার কর্তৃক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই নেই কোনো ট্রেড লাইসেন্স, নেই কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। কিন্তু তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
তাদের ভেতর যে স্পৃহা এসেছে সেটা তারা বন্ধ করছেন না। তাহলে আমাদেরও উচিত তাদের এই কাজকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করা।
আমাদের নারীরা কঠিন সময়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আমরা শুধু রান্নাবান্নাই পারি তা না, প্রয়োজনে অর্থনৈতিক হালও ধরতে পারি। তাই আমাদের নারীদের উন্নয়নের জন্য আমার কিছু প্রস্তাবনা আছে,
প্রথমেই, তাদের সবাইকে স্কিল ডেভেলপমেন্টের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সরকার পক্ষ থেকে ফ্রি ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা যেন হয় উন্নত মানের প্রশিক্ষণ।
দ্বিতীয়ত, নারী উদ্যোক্তাদের প্রথমেই লোন বা প্রণোদনা প্যাকেজ না দিয়ে ছোট ছোট অনুদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেই অনুদান হবে এককালীন। যেটা দিয়ে নারীরা ছোট আকারে তাদের উদ্যোগের কাজে লাগাতে পারবেন। সেটা মনিটরিং এবং মেন্টরিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি নারীদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ভেতর নিয়ে আসতে হবে। যাতে করে ফেসবুকের সমস্যা হলেও যেন নারীদের উদ্যোগ বন্ধ না হয়।
পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রদর্শনীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত কিছু আয়োজন করা যেতে পারে। তাতে করে আমাদের উদ্যোক্তাদের পণ্য সামনাসামনি সবাই দেখতে পারবেন এবং এতে করে নেটওয়ার্কিং এর একটা প্ল্যাটফর্মও তৈরি হয়।
পণ্য প্রদর্শনী বা মেলা যেটাই বলি না কেন সেটা করতে হবে একদম স্বল্প মূল্যে, যাতে করে উদ্যোক্তাদের ওপর কোনো চাপ না পড়ে। খুব ভালো হয়, যদি বছরে বিভিন্ন জেলা শহরে তিনটা মেলা করা যায়, তার ভেতর উদ্যোক্তাদের জন্য একটা মেলা সম্পূর্ণ ফ্রি করে দেওয়া উচিত।
নারী উদ্যোক্তাদের প্রথমেই লোন বা প্রণোদনা প্যাকেজ না দিয়ে ছোট ছোট অনুদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেই অনুদান হবে এককালীন।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, নবীন উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য এক্সপোর্টও করছেন। তবে এক্সপোর্ট করার যে নিয়মনীতি আছে, যে ধরনের ডকুমেন্ট তৈরি করতে হয়, তার কিছুই তারা জানেন না। আবার পণ্য দেশের বাইরে এক্সপোর্ট করতে গেলে বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়। সেই খরচ কমিয়ে আনতে আমাদের সরকার যদি পোস্টাল সার্ভিসকে ডিজিটাল করতে পারে এবং সেই সাথে রপ্তানি বিষয়ে যে ধরনের ১৫ থেকে ২০টা কাগজ ও লাইসেন্স রেডি করতে হয় তা যদি আরও সহজ করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে আমাদের নারীদের একটি বড় ভূমিকা থাকবে বলে আমি মনে করি।
একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, ই-কমার্স নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা থাকুক না কেন গত কয়েকটি মাস, নারী উদ্যোক্তারা কিন্তু তাদের উদ্যোগকে বন্ধ করে রাখেননি। তারা তাদের উদ্যোগ চালিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। আমাদের দায়িত্ব তাদের সমৃদ্ধির জন্য, আত্ম উন্নয়নের জন্য উপরোক্ত কাজগুলো করে যাওয়া।
আমাদের নারী সমাজ বর্তমানে যেভাবে এগিয়ে এসেছে নিজের সংসার এবং নিজের দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য, আমি বিশ্বাস করি তাদেরকে সঠিকভাবে গাইড করতে পারলে, তারা দেশের অর্থনীতিতে বিশাল বড় অবদান রাখতে পারবে।
নাসিমা আক্তার নিশা ।। প্রেসিডেন্ট, ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)
nishabd2012@gmail.com