গ্রীষ্মের অন্যতম ফল বাঙ্গি চাষে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠছে নরসিংদীর চরাঞ্চল। এ চরাঞ্চলের বাঙ্গি আকারে বড়, দেখতে সুন্দর ও স্বাদে অনন্য হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। অল্প শ্রম ও খরচে অধিক লাভবান হওয়ায় প্রতি বছরই নরসিংদীর চরাঞ্চলে বাড়ছে বাঙ্গির আবাদ। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থানেরও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের বেশির ভাগ চরাঞ্চলেই বাঙ্গি উৎপন্ন হয়। পলি, পলি দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ- এসব মাটি বাঙ্গি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বাঙ্গি বেশ বড় হয়। কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকে, পাকলে হলুদ রঙের হয়। একটু বেশি পেকে গেলে বাঙ্গি সহজে ফেটে যায়। ফলের বাইরের দিকটা মিষ্টি কুমড়ার মতো হালকা ডোরাকাটা খাঁজযুক্ত। এর ভেতরটা ফাঁপা থাকে। খেতে তেমন মিষ্টি নয়। তবে চিনি, গুড় দিয়ে খেতে দারুন।
জেলায় এ বছর ৭৪ হেক্টর জমিতে বাঙ্গির আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে রায়পুরা উপজেলায় ৩৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে বাঙ্গি। যার মধ্যে বাঁশগাড়িতে ২০ হেক্টর ও বাকি ১৫ হেক্টর পাড়াতলীর মধ্যনগর, চাঁনপুর ও মির্জাচরে আবাদ হয়েছে।
মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ি ও পাড়াতলী ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে বিশাল চর। বিস্তীর্ণ চরে ধান ও মসলা জাতীয় ফসলের পাশাপাশি বাঙ্গি চাষ করা হয়েছে। মাটির ওপর ছড়িয়ে রয়েছে বাঙ্গিগাছের সবুজ লতা। লতার ফাঁকে ফাঁকে কাঁচা-পাকা বাঙ্গি শোভা পাচ্ছে।
কৃষকরা জানান, বাঙ্গি চাষ করতে তেমন খরচ লাগে না। রসুন ও বাঙ্গি দুই ফসল একবারে চাষ করেন তারা। রসুন তুলে নেওয়ার পর বাঙ্গি বিক্রি শুরু হয়। ভালো লাভ পাওয়ায় প্রতি বছর বাড়ছে বাঙ্গির আবাদ।
জমি থেকেই বাঙ্গি কিনতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারি ক্রেতারা কৃষকদের সঙ্গে দরদাম করছেন। দুই পক্ষের যুক্তিতর্কে চলছে বেচাকেনা। জমি থেকে প্রতিটি বাঙ্গি পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। পরে পাইকারদের মাধ্যমে সুস্বাদু এ ফলটি পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। খুচরা পর্যায়ে যা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়।
ঢাকা থেকে বাঙ্গি কিনতে এসেছেন পাইকারি ফল ব্যবসায়ী আকবর হোসেন। তিনি বলেন, বাজারে রায়পুরার চরের বাঙ্গির চাহিদা অনেক। এটি সুস্বাদু ও আকারে বড় হওয়ায় ক্রেতারা পছন্দ করে বেশি। ফলে কম সময়ে অধিক পরিমাণে বিক্রি করা যায়। এবার আমি ২৫০টি বাঙ্গি কিনেছি। শতক প্রতি দাম পড়েছে পাঁচ হাজার টাকা।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী নাদিম হোসেন বলেন, বাঙ্গির আকার ভেদে দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। প্রতিদিনই আমরা ৫০০ থেকে ৭০০ বাঙ্গি কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যাই। তবে চরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় বাঙ্গি পরিবহনে খুব কষ্ট করতে হয়। পরিহবহন খরচ ও বেড়ে যায়। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হলে আমরা আরও বেশি বাঙ্গি কিনতে পারতাম।
মাঠ থেকে তোলা বাঙ্গি সড়কপথে ও নৌপথে নেওয়া হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। জমি থেকে প্রতিপিছ বাঙ্গি পাইকারদের গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে মৌসুমি শ্রমিকরা পান সাত থেকে ১০ টাকা। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থানেরও। তবে চরের রাস্তাটি কাঁচা হওয়ায় বাঙ্গি পরিবহনে তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
মৌসুমি শ্রমিক হাফিজ মিয়া বলেন, আমরা ক্ষেত থেকে ঝুড়িতে করে বাঙ্গি পাইকারদের ট্রাক বা নৌকায় তুলি। এভাবে আমরা প্রতিদিন ৮০০ থেকে হাজার টাকা আয় করে থাকি। তবে রাস্তায় খানাখন্দ থাকায় আমাদের বেশি কষ্ট করতে হয়। রাস্তা ভালো থাকলে আমাদের আয় আরও বেড়ে যেত।
আরেক শ্রমিক হাসান মিয়া বলেন, মার্চ-এপ্রিল মাসে আমরা পাইকারদের ট্রাক বা নৌকায় বাঙ্গি তোলার কাজ করি। প্রায় অর্ধ শতাধিক শ্রমিক এ কাজ করে তাদের সংসার চালাচ্ছেন। রাস্তা খারাপ থাকায় আমাদের মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। রাস্তাগুলো মেরামত করা হলে আমাদের কাজ করতে সুবিধা হতো।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, অল্প খরচে বোশ লাভ হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে বাঙ্গির আবাদ। এবার জেলায় বাঙ্গির বাম্পার ফলন হয়েছে। যা থেকে উৎপাদন হবে প্রায় এক হাজার টন বাঙ্গি। যার বাজার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। বাঙ্গি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হওয়ায় দিনদিন এর চাহিদা বাড়ছে। আগামীতে বাঙ্গির আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করছে। কৃষকদের পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে